করোনার প্রভাব পড়ছে সারা পৃথিবীর আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও শিক্ষাব্যবস্থার ওপর। এর প্রভাবে সারা দুনিয়ায় এ পর্যন্ত মারা গেছেন প্রায় দুই লাখ মানুষ এবং আক্রান্ত হয়েছে ২৮ লাখের বেশি। ক্রমশ যেন এর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ফলে আক্রান্ত সব দেশে চলছে লকডাউন, শাটডাউন, সঙ্গনিরোধ ও সামাজিক দূরত্ব অবলম্বনসহ নানা বিধি। ব্যবসা বাণিজ্য, উৎপাদন, নির্মাণ থেকে শুরু করে সব রকম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে।
আমরা জানি, দেশ পরিচালনায় অর্থের সমৃদ্ধি ও সক্ষমতা অতীব আবশ্যক এবং তা আপেক্ষিকতার নিরীখে চলমান প্রক্রিয়া। কিন্তু শিক্ষার উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির ধারাবাহিকতার বিচারে সুদূর প্রসারী ও সামগ্রিকভাবে মূল চালিকাশক্তি। করোনার প্রাদুর্ভাবে সৃষ্ট বর্তমান সংকট সব থেকে বেশি ক্ষতি করে চলেছে শিক্ষাব্যবস্থার। শিক্ষার এ ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে লেগে যাবে দীর্ঘদিন। তাতে জাতির উন্নতি হবে বহুলাংশে ব্যাহত ও ক্ষীণ গতিসম্পন্ন।
শিক্ষা ব্যবস্থাপক ও শিক্ষা প্রদান কাজে যারা জড়িত বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ পড়েছে উভয় সংকটে; তাঁরা না পারছেন প্রতিষ্ঠান খোলা রাখতে, আবার না পারছেন শিক্ষার ধারা কার্যকরী রাখতে। উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলো অনলাইনের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম কিছুটা চালু রাখলেও তা অতি অল্প সংখ্যক প্রতিষ্ঠানে এবং তা আবার খুবই অল্প পরিসরে। কিন্তু ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে আমাদের স্কুল-কলেজগুলো। সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সামগ্রিক স্কুলিং তথা শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
পড়ালেখার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হলো শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নিয়মিত স্কুলে আসা এবং দিনের কার্যসূচি অনুযায়ী রুটিন মাফিক শিক্ষণ ও শিখন কর্ম পরিচালনা করা। লকডাউন বা সামাজিক দূরত্ব বিধি মানার ফলে এ স্বাভাবিক প্রক্রিয়া চরমভাবে ব্যাহত হয়, ফলে এর ক্ষতিকর প্রভাব সব স্তরেই ভোগ করতে হয়। নিম্নে এ ব্যাপারে কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোকপাত করা হলো:
শিক্ষার্থীদের ওপর প্রভাব
শিক্ষার্থীরা হচ্ছে স্কুল-কলেজের প্রাণ। তাদের উপস্থিতি ও নিয়মিত পড়াশোনা শিক্ষা ধারাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। লকডাউনের কারণে শিক্ষার্থীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। যেমন:
১. স্কুল খোলা কালে ছেলেমেয়েরা নিয়মিত স্কুলে যায়, বন্ধু বান্ধব ও সহপাঠীদের সাথে আনন্দ স্ফূর্তির মাধ্যমে পড়ালেখা করে দিনের অধিকাংশ সময় অতিক্রম করে থাকে। ফলে তাদের মন মানসিকতা ফুরফুরে মেজাজের হয় এবং জীবনযাপনের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে। কিন্তু স্কুল দীর্ঘদিন বন্ধ থাকলে ছেলেমেয়েরা বাসায় বসে অনেক ক্লান্তি ও অস্বস্তি বোধ করে থাকে। তাতে এরা মানসিকভাবে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
১. স্কুল খোলা কালে ছেলেমেয়েরা নিয়মিত স্কুলে যায়, বন্ধু বান্ধব ও সহপাঠীদের সাথে আনন্দ স্ফূর্তির মাধ্যমে পড়ালেখা করে দিনের অধিকাংশ সময় অতিক্রম করে থাকে। ফলে তাদের মন মানসিকতা ফুরফুরে মেজাজের হয় এবং জীবনযাপনের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে। কিন্তু স্কুল দীর্ঘদিন বন্ধ থাকলে ছেলেমেয়েরা বাসায় বসে অনেক ক্লান্তি ও অস্বস্তি বোধ করে থাকে। তাতে এরা মানসিকভাবে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
২. লকডাউন অবস্থায় ছাত্রছাত্রীদের দৈনন্দিন রুটিন কর্মের মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটে। নিয়মিত ঘুম থেকে ওঠা, পড়ার টেবিলে বসা, বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকদের দেয়া হোমওয়ার্ক সম্পন্ন করা ইত্যাদির সবই নিয়মিত কর্মসূচির অংশ। স্কুল বন্ধ অবস্থাতে ছেলেমেয়েদের এ জাতীয় রেগুলার কাজের মাঝে অনিয়মিত ভাব পরিলক্ষিত হয় যা তাদের জন্য দীর্ঘ মেয়াদী ক্ষতি বয়ে আনবে।
৩. প্রতিদিন শিক্ষকদের সাথে শ্রেণিকক্ষে বসে শিক্ষাগ্রহণ করা, তাদের সাথে জ্ঞানের আলাপ করা, নিত্যনৈমিত্তিক নতুন নতুন জ্ঞান অর্জনসহ নানা দিক থেকে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হয়। কিন্তু স্কুল বন্ধ থাকলে এ জাতীয় সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত হয়। ফলে শিক্ষার মান চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। প্রকৃত শিক্ষা লাভের পরিবেশ থেকে ছাত্রছাত্রীরা অনেক দূরে সরে যায়।
৪. অনেক সময় ধরে স্কুলে যেতে না পারা শিক্ষার্থীদের মানসিক উন্নয়নের জন্য বেশ হুমকিস্বরূপ। প্রতিদিন প্রকৃতির সান্নিধ্যে থেকে বাইরের আলো, বাতাস, পানি ও মাটির ছোঁয়া নিয়ে বেঁচে থাকার মাঝেই মূলত ছেলে মেয়েদের আনন্দ। লকডাউনের কারণে বহুদিন ধরে গৃহবন্দি থেকে জীবনযাপন করলে শিক্ষার্থীদের মন-মানসিকতার উপরে চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়ে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ সংস্থা (WHO) এর মতে প্রতিদিন ছেলেমেয়েদের কমপক্ষে ৪৫ থেকে ৬০ মিনিট এবং বয়স্কদের জন্য অন্যূন ৩০ মিনিট শারীরিক কসরত আবশ্যক। স্কুল খোলা থাকলে শিক্ষার্থীরা এ সুযোগ পেয়ে থাকে ফলে তারা মানসিকভাবে সুস্থ ও ভালো থাকে।
৫. দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকার কারণে ছেলেমেয়েরা বাসা-বাড়িতে সম্পূর্ণ গৃহবন্দির মতো জীবনযাপন করে। ফলে তাদের মধ্যে এক ধরনের দুষ্টুমি, প্রাণ চঞ্চলতা, অবসাদ প্রবণতা ইত্যাদি পরিলক্ষিত হয় যা সুশৃঙ্খল জীবনযাপনের পরিপন্থি।
৬. লকডাউনের ফলে স্কুল-কলেজ বন্ধ হওয়াতে ছেলে মেয়েদের যে বন্দিদশার জীবন শুরু হয় তা তাদের জন্য বেশ ক্ষতিকর। তাদের স্বাভাবিক আচার আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। তাদের পারস্পরিক আলাপ, ওঠা বসায় ভদ্রতা, স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে অস্বাভাবিকতা প্রকাশ পায়। ফলে অনেক ক্ষেত্রে পরিবারে অশান্তি সৃষ্টি হয়।
৭. স্কুল বন্ধ থাকার কারণে ছেলেমেয়েরা পড়াশোনায় তেমন কোনো চাপ বোধ করে না এবং গৃহস্থলীর কোনো কাজও করে না। ফলে তাদের খাওয়া দাওয়ার ক্ষেত্রে চরম অনিয়ম পরিলক্ষিত হয় এবং যেমন খুশি তেমনভাবে যা তা খেতে থাকে। এতে করে ছেলেমেয়েরা স্বভাবতই স্থূলতা ও অলসতায় ভুগে থাকে। ঘরবন্দি জীবনযাপন তাদেরকে শারীরিকভাবেও অনেক ক্ষতি করে থাকে।
৮. প্রবাদ রয়েছে ‘অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা’। এ দীর্ঘদিন লকডাউনের কারণে ছাত্রছাত্রীরা অধিকাংশ সময়ে বাড়িতে অলস সময় কাটিয়ে থাকে, ফলে তাদের মস্তিষ্ক কিছুটা ভিন্ন দিকে প্রবাহিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। পর্যালোচনায় দেখা যায় বাসায় বসে অনিয়ন্ত্রিতভাবে তারা সোস্যাল মিডিয়াতে বেশি জড়িয়ে পড়ে। ফেসবুক, ইউটিউব, ইন্সট্রাগ্রাম, লিংডইনসহ নানাবিধ বিনোদন কর্মের সাথে যুক্ত হয়ে যায়। এমনকি এর এক পর্যায়ে গভীরভাবে আসক্ত হয়ে পড়ে যা শিক্ষার্থীদের মেধা বিকৃতির মতো নানা ধরনের ক্ষতি সাধিত হয়।
শিক্ষকদের ওপর প্রভাব
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার্থীদের মতো শিক্ষকেরাও ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। যেমন:
১. প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষকদেরকে কর্মহীন হয়ে বসে থাকতে হয়। ফলে তাদের শিক্ষকতার পেশায় অদক্ষতা প্রকাশ পায়। ছাত্রছাত্রীদেরকে পাঠদান কালে শিক্ষকদের অনেক পড়াশুনা করতে হয়, পাঠ পরিকল্পনা প্রস্তুত করতে হয় এবং শিক্ষা সহায়িকার ব্যবস্থা করতে হয়। স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকলে তাঁরা এ সকল কাজ থেকে দূরে সরে যায়, ফলে দিন দিন তাদের অদক্ষতা বৃদ্ধি পায়।
২. দীর্ঘদিন স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষকদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। প্রতিদিন নিয়মিত অভ্যাসমতো ঘুম থেকে উঠা, প্রয়োজনীয় কাজ কর্ম সেরে স্কুলে যাওয়া এবং যথারীতি শিক্ষাদানে ব্যস্ত থাকা তাঁদের নিয়মিত কর্মসূচি। কিন্তু, এটা সম্ভব হয় না লকডাউনের কারণে স্কুল বন্ধ হয়ে গেলে।
৩. অধিকাংশ শিক্ষক যারা বিশেষ করে প্রাইভেট টিউশনি করেন বা বেসরকারি কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন, তাঁদের অর্থ উপার্জনও কমে যায়। এমনকি সঞ্চিত কোনো অর্থ না থাকায় তাঁরা সংসার চালাতে হিমশিম খান। সমাজে এদের সংখ্যাই বেশি।
৪. সারাদিন বাসা বাড়িতে বসে থাকার কারণে শিক্ষকরা একদিকে যেমন অলস হয়ে যান অন্যদিকে শারীরিকভাবেও তাঁরা স্থূলকায় হয়ে পড়েন। ফলে স্বাভাবিক জীবনে অনেক রোগ ব্যাধির সম্মুখীন হন।
৫. দীর্ঘদিন স্কুলের কার্যক্রম না থাকায় ছাত্রছাত্রীদের সাথে শিক্ষকদের শিক্ষার আদান প্রদান ব্যাহত হয়। ফলে শিক্ষার্থী-শিক্ষক সম্পর্কের বেশ কিছুটা বিচ্যুতি ঘটে। শিক্ষকদের সাথে শিক্ষার্থীদের নিয়মিত দেখা হওয়ার ফলে যে সৌহার্দপূর্ণ ইতিবাচক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকতো তা আর থাকে না।
অভিভাবকদের ওপর প্রভাব
লকডাউন ও সামাজিক দূরত্ব বিধি আরোপের কারণে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের ওপর যেমন নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে তেমন পিতা মাতা বা শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের ওপরও অনেক প্রভাব পড়ে থাকে। যেমন:
১. স্কুলের বন্ধ ঘোষণা বা সঙ্গনিরোধ নীতি মাতা-পিতা ও অভিভাবকদের ওপর চরম প্রভাব পড়ে থাকে। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার কি হবে, সিলেবাস শেষ হবে কি না, পরীক্ষা কীভাবে দেবে, পরীক্ষা না হলে রেজাল্ট কীভাবে হবে এবং সর্বোপরি তাদের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ কি হবে ইত্যাদি নানাবিধ বিষয়ে তাঁরা হতাশায় ভোগেন। তাদের এ হতাশার প্রভাব গোটা পরিবারের উপর পড়ে এবং কিছুটা হলেও অশান্তি সৃষ্টি হয়।
২. ছেলেমেয়েরা সার্বক্ষণিক বাসায় থাকার কারণে তাদের মধ্যে যে একগুয়েমিভাব, দুষ্টুমি, চঞ্চলতা ও অলসভাবে সময় কাটানোর বিষয়টি অভিভাবকদের দেখা যায় তাতে অভিভাবকেরা মানসিকভাবে অনেকটা বিপর্যস্ত থাকে। লকডাউনের কারণে মাতা পিতার উপর যে নেতিবাচকপ্রভাব পড়ে তা অত্যন্ত ক্ষতিকর।
৩. দীর্ঘদিন লকডাউনের ফলে ছেলে মেয়েদেরকে সবসময়ই গৃহবন্দি থাকতে হয়। আর এ কারণে অভিভাবদেরকে হিমশিম খেতে হয় তাদের সন্তানদের সামাল দিতে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একদিকে ছেলেমেয়েরা যেমন বিরক্ত করে অন্যদিকে বাবা-মাও অনেক সময় খারাপ আচরণ করে ফেলে, যা এ দীর্ঘদিন বাসায় থাকার কারণেই হয়ে থাকে।
প্রতিষ্ঠানের ওপর প্রভাব
লকডাউনের কারণে অধিক কাল ধরে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকার ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হতে পারে। যেমন:
১. সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই সরকারি বা বেসরকারি নির্দিষ্ট নিয়ম নীতির আলোকে পরিচালিত হয়। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার ফলে এ সব নিয়ম নীতি পালনে অনেক বিচ্যুতি ঘটে। ফলে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মাঝে নানা ধরনের নিয়ম শৃঙ্খলা পরিপন্থি কাজের অভিযোগ পরিলক্ষিত হয়।
২. সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই তাদের নিজেস্ব একাডেমিক বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী কারিকুলাম ও সিলেবাস প্রণয়ন করে থাকে। হঠাৎ করে লকডাউন বিধান কার্যকরী করায় শিক্ষাদান যেহেতু বন্ধ প্রায় হয়ে যায়, সেহেতু তাদের পরিকল্পিত সিলেবাস শেষ করা সম্ভব হয় না। ফলে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে সকল বার্ষিক কার্যক্রম।
৩. আবার দীর্ঘদিন এভাবে বন্ধ থাকলে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ বিচলিত হয়ে পড়েন শিক্ষার্থীদের সময়মতো পরীক্ষা না নিতে পেরে। ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের নানা প্রকার মন্তব্য ও অনাকাঙ্ক্ষিত আবদার প্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক কর্মধারাও ব্যাহত করে।
৪. লকডাউনের কারণে স্কুল কর্তৃপক্ষ আরেকটি বড় ঝুঁকির মধ্য পড়ে যান, তাহলে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সময়মতো বেতন ভাতা প্রদান করতে না পারা। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকরিরতদের তেমন সমস্যা না হলেও সবথেকে বড় সমস্যায় পড়তে হয় বেসরকারিভাবে পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুল। শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি দ্বারা পরচালিত এ প্রতিষ্ঠানগুলি সময়মতো ফি সংগ্রহ করতে না পারায় তারা বিপাকে পড়েন সকলের বেতন প্রদান করতে গিয়ে। ফলে এ নিয়ে সৃষ্ট মিশ্র প্রতিক্রিয়া কর্তৃপক্ষকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয়।
সমাধানে কতিপয় পরামর্শ:
১. স্কুল কর্তৃপক্ষের জন্য আবশ্যক বর্তমান এ আধুনিককালে অনলাইনভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখা। আজকাল ডিস্ট্যান্স লার্নিংয়ের আওতায় অসংখ্য শিক্ষা বিষয়ক অ্যাপস আবিষ্কৃত হয়েছে যা দিয়ে অতি সহজে লকডাউনে থেকেও বাড়িতে বসে শিক্ষা দান ও গ্রহণ করা যায়। এছাড়াও গুগল ক্লাসরুম, গুগল হ্যাংসাউট মিট, স্কাইপ, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপসহ বিভিন্ন ধরনের ওয়েবসাইট রয়েছে যার মাধ্যমে সহজেই শ্রেণি কার্যক্রম চালানো যায়। দৈনন্দিন পাঠ পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্লাস পরিচালনা করলে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা মানসিকভাবে অনেকটা স্বস্তি লাভ করতে পারে। আমাদের সরকার যেমন ইতোমধ্যে সংসদ টিভি, শিক্ষা বাতায়ন ও শিক্ষা বোর্ড ভিত্তিক কতিপয় মোডিউলের মাধ্যমে শিক্ষাদান অব্যাহত রেখেছেন। তাছাড়া শিক্ষা ও পাঠদানের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের সব সিদ্ধান্ত সবার আগে পাওয়া যায় শিক্ষা বিষয়ক দেশের একমাত্র পত্রিকা দৈনিক শিক্ষাডটকম-এ। সব প্রতিষ্ঠানই অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন।
২. প্রতিদিন শিক্ষকরা রুটিন মাফিক বিভিন্ন শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের সাথে হায়, হ্যালো করে কুশলাদি বিনিময়ের কাজ করতে পারেন। যাতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় থাকে এবং আপদকালীন সমস্যার সমাধানে একে অন্যে এগিয়ে আসতে পারে।
৩. অনলাইনের মাধ্যমে মাঝে মাঝে শিক্ষার্থী-শিক্ষক-অভিভাবক সম্মেলন করা যেতে পারে। ফলে সকলের মাঝে পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকে এবং মানসিক দিক থেকে সকলে শান্তিপূর্ণ অবস্থায় বসবাস করতে পারে।
৪. শিক্ষকরা মাঝে মাঝে শ্রেণিভিত্তিক সাবজেক্ট অনুযায়ী শিক্ষার্থীদেরকে পাঠ প্রদান করে বাড়ির কাজ দিতে পারেন, যেন তারা বাসায় পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন এবং ভিন্ন কোনো কাজে মন বসাতে না পারে।
৫. ছাত্রছাত্রীরা বাড়িতে বসে স্ব স্ব কাজে নিয়োজিত থাকতে পারে। লকডাউন অবস্থায় তারা যে কোনো প্রকার প্রযুক্তিগত শিক্ষা অর্জন করে তাদের ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার গঠন কাজে এগিয়ে থাকতে পারে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিভা অনুযায়ী আর্টস ও শিল্পকলায় মনোনিবেশ করতে পারে।
৬. অভিভাবকরা তাদের ছেলেমেয়েদের পাশে থেকে সর্বদা বুদ্ধিমত্তা, সাধারণ জ্ঞান ও মেধা চর্চার কাজে সহযোগিতা করতে পারেন। দীর্ঘদিন লকডাউনে থাকার ফলে ছেলেমেয়েরা যেন মানসিক ব্যধিতে আক্রান্ত না হয় সে দিকে যথাযথভাবে নজর দিতে হবে।
৭. শিক্ষক ও অভিভাবক মিলে ছেলেমেয়েদেরকে আদর্শ ও নৈতিক শিক্ষার জ্ঞান প্রদান করে নিয়মিত ইতিবাচক মোটিভেশন ও সততা চর্চার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করতে পারেন। যার যার ধর্ম অনুযায়ী ইবাদাত-বন্দেগী করতে উৎসাহিত করা যেতে পারে।
৮. করোনার প্রভাবে দীর্ঘদিন গৃহবন্দি থাকার কারণে ছেলেমেয়েরা স্বভাবতই খাওয়া-দাওয়ার প্রতি অনিয়ন্ত্রিত থাকে, ইচ্ছামতো যা খুশি তাই ভক্ষণ করে থাকে। ফলে তাদের শরীর স্থূলাকায় হয়ে যায় এবং নানাবিধ সমস্যার সৃষ্টি হয়। এ জন্য অভিভাবকদের উচিত তাদের খাবারের প্রতি খেয়াল রাখা। বাড়ির ভিতরেই প্রতিদিন পরিমিত ব্যায়াম করার সুযোগ করে দেয়া এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন জীবনযাপনে উৎসাহিত করা। তাহলে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং স্বাস-প্রস্বাসে স্বস্তি ফিরে আসবে।
৯. ছাত্রছাত্রীরা তাদের সুবিধামতো সময় অনুযায়ী শিক্ষকদের সাথে পরামর্শ করে দৈনন্দিন কর্মসূচি বা কর্ম পরিকল্পনা তৈরি করতে পারে। সে মোতাবেক তারা তাদের খাওয়া, দাওয়া, ঘুম ও পড়াশোনা করতে পারে। তাদের কর্মসূচিতে অবশ্যই হালকা ব্যায়ামের সময় থাকতে হবে এবং সে অনুযায়ী নিয়মিতভাবে শরীর চর্চা করতে হবে।
১০. স্কুল কর্তৃপক্ষ যদি স্কুল ব্যবস্থাপনায় অটোমেশন পদ্ধতি চালু রাখতে পারে তাহলে সেটি হতে পারে অভিভাবক ও ছাত্রছাত্রীদের সাথে যোগাযোগ লাভের শ্রেষ্ঠ উপায়। ফলে কর্তৃপক্ষ যেমন সকলের সাথে সহজে যোগাযোগ রেখে জরুরি কোনো নোটিশ প্রদান করতে পারে। অনুরূপভাবে, অভিভাবকেরাও তাদের প্রয়োজনীয় কাজ যেমন টিউশন ফিসহ যাবতীয় পাওনাদি পরিশোধ করতে পারেন। এতে পরস্পর পরস্পরের মধ্যে একটি সুসম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং যে কোনো সংকট সমাধানে একতাবদ্ধভাবে কাজ করা যায়।
১১. করোনাকালীন এ জাতীয় সংকটে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ সম্মিলিতভাবে সচেতন থেকে সকল সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে। সামাজিক দূরত্ব বিধি ও সরকার কর্তৃক প্রদত্ত যে কোনো নীতি অবলম্বন করে সরকারকে সহায়তা করা উচিৎ।
এদিকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় জাতীয় টেলিভিশনের মাধ্যমে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত কিছু কিছু বিষয়ের পাঠদান করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বটে তা আবার আপামর সর্ব সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের কাছে পৌছায় না, যথেষ্টও নয়।
আমরা প্রভুর কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন করোনার অভিশাপ থেকে আমাদেরকে রক্ষা করেন এবং শিক্ষাব্যবস্থার ওপর যে ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে তা পুষিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেন।
লেখক : ড. মো. মাহমুদুল হাছান, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও প্রিন্সিপাল, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা।
Comments
Post a Comment